প্লাস্টিক-দূষণে বছরে ১০ লাখ প্রাণীর মৃত্যু

নদীনালা খাল-বিল সাগর এখন ক্ষতিকর প্লাস্টিকে সয়লাব। শহর নগর গ্রামের রাস্তাঘাটসহ যত্রতত্র প্লাস্টিকের ছড়াছড়ি। এসব প্লাস্টিক বোতল ও পলিথিন ব্যাগের বেশির ভাগই পুনর্ব্যবহার, পুনঃচক্রায়ন না করে প্রাকৃতিক পরিবেশে যত্রতত্র ফেলা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে এভাবে ক্ষতিকর প্লাস্টিক পণ্য যেখানে সেখানে ফেলে মানুষ নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনছে। কেননা অপচনশীল এসব ক্ষতিকর প্লাস্টিক নর্দমা ড্রেন হয়ে নদীনালা ও সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে। পানি, মাটি ও পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি ডেকে আনছে।
প্লাস্টিক কেন ক্ষতিকর?
১৯৭০ সালে সর্বপ্রথম সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় প্লাস্টিকের উপস্থিতি সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তখন থেকে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। সম্প্রতি থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে ছোট্ট পাইলট তিমির পেটে প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক দেখে আঁতকে উঠেছে সবাই। সামুদ্রিক ডলফিন পরিবারের সদস্য স্তন্যপায়ী এ প্রাণীর দেহে ৬৪ পাউন্ড পাস্টিক পাওয়া গেছে। তার পেটে মিলেছে প্লাস্টিক ব্যাগ, জাল, দড়ি, পাস্টিকের বস্তা এমনকী প্লাস্টিকের জ্যারিক্যানও। প্লাস্টিক থেকে ব্যাক্টিরিয়া ও ছত্রাক সংক্রমণ হয়ে যাওয়ায় ধীরে ধীরে মারা যায় তিমিটি।
পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক মুহাম্মদ সোলায়মান হায়দার তার এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, বছরে ৮০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে পড়ছে। প্লাস্টিকের দূষণে বছরে ১০ লাখ প্রাণী মারা যাচ্ছে। প্রতি বছর ৪০০ কোটি প্লাস্টিক বোতল তৈরি হচ্ছে। ২০০৫ থেকে ২০১৪ সালের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বিশ্বে প্লাস্টিকের উৎপাদন বেড়েছে। তিনি জানান, বাংলাদেশে ১০ শতাংশ বর্জ্য প্লাস্টিক থেকে আসে যার পরিমাণ প্রায় সতের হাজার টন। তিনি তার গবেষণায় আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এভাবে বাড়লে এক সময় সাগরে মাছের চেয়ে প্লাস্টিকই বেশি থাকবে। অন্য দিকে আন্তর্জাতিক এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে এ মুহূর্তে পাঁচ লাখ কোটিরও বেশি প্লাস্টিকের তৈরি দ্রব্য ভাসছে বিভিন্ন সাগর-মহাসাগরে।

এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন এসডোর গবেষণা উঠে এসেছে পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি এসব প্লাস্টিক মানবদেহের বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগের কারণ। মানবদেহে এসব প্লাস্টিক ও এর কণা টাইপ ২ ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যান্সার প্রভৃতি ভয়াবহ রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত নয়া দিগন্তকে বলেন, এটি প্লাস্টিকের দোষ না। যারা প্লাস্টিক ব্যবহার করে সে ব্যবহারকারীরাই দায়ী। কারণ তারা এটি ব্যবহার করে যত্রতত্র ফেলে রাখে। উন্নত বিশ্বে প্লাস্টিক ব্যবহারকারী একবারই তা ব্যবহার করে নিদিষ্ট স্থানে জমা করে রাখে। পরে এটি যারা পুনঃব্যবহার করতে চায় তারা নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যায়। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, কোনোভাবে একটি প্লাস্টিক বোতল দ্বিতীয়বার ব্যবহার করা স্থাস্থ্যকর না। এ ছাড়া পাতলা পলিব্যাগ উৎপাদনের তিনি বিরোধিতা করেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, পাতলা পলিব্যাগই একবার ব্যবহার করে তা যত্রতত্র ফেলে দেয়া হচ্ছে।
অন্য দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: আবদুর রব মোল্লা বলেন, যে কয়েকটি জিনিস মাটি, পানি পরিবেশের সব চেয়ে বেশি ক্ষতি করে তা হলো এই প্লাস্টিক আর রাসায়নিক দ্রব্য। এগুলো দীর্ঘ দিন ধরে পরিবেশে জমে থাকতে পারে। প্লাস্টিক কয়েক শ’ বছর মাটির নিচে জমে থাকতে পারে। এটি এভাবে বছরের পর বছর আমাদের ভূগর্ভে পানি রিচার্জ হতে বাধা সৃষ্টি করবে। তিনি বলেন, নদীনালা খাল-বিলের নিচে এখন টনকে টন ক্ষতিকর প্লাস্টিক জমে আছে। তাই প্লাস্টিক ব্যবহারে এখনই সবার সতর্ক হতে হবে।

এসডোর মহাসচিব ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি মানবস্বাস্থ্যের জন্যও মাইক্রোপ্লাস্টিক হুমকি স্বরূপ। এখনই উপযুক্ত সময় মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষার্থে প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করুন। মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা সামুদ্রিক ইকোসিস্টেম এবং মানবস্বাস্থ্যের জন্য ডেকে আনছে মারাত্মক হুমকি।
ক্ষতিকর এ প্লাস্টিক দূষণকে সামনে রেখেই আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হতে যাচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে বিট দ্য প্লাস্টিক পলিউশান- আসুন প্লাস্টিক দূষণ বর্জন করি। অন্য দিকে এবারে এ দিবসকে সামনে রেখে পরিবেশ অধিদফতরের স্লোগান নির্ধারণ হচ্ছে ‘ইফ ইউ ক্যান নট রিইউজ ইট, রিফিই্জ ইট’- ‘আসুন প্লাস্টিক পুনঃব্যবহার করি, না পারলে বর্জন করি।’ এ উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারিভাবে বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন সভা সেমিনারের আয়োজন করেছে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) উদ্যোগে পবা কার্যালয়ে প্লাস্টিক দূষণ : পরিবেশের জন্য হুমকি ও আমাদের করণীয় শীর্ষক এক সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে।